শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৬

মন্দির/তীর্থস্থান/পীঠস্থান


কালিকাপুরাণ মতে, চার মহাপীঠ তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র। এগুলির মধ্যে পশ্চিমদিকের পীঠটি হল ওড্ডীয়ন বা উড্ডীয়ন অঞ্চলের কাত্যায়নী। এই পীঠের ভৈরব জগন্নাথ। বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না, এই ওড্ডীয়ন বা উড্ডীয়ন হল আজকের ওড়িশা।

আর এই কাত্যায়নী হলেন শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ ধামের রক্ষয়িত্রী দেবী বিমলা। পীঠশক্তি রূপে কাত্যায়নীর নাম পাওয়া যায় হেবজ্র তন্ত্র গ্রন্থেও। সেখানে তাঁকে বলা হয়েছে উড্র পীঠের ভৈরবী। আর সেখানেও ভৈরব হলেন জগন্নাথ।
দক্ষকন্যা সতীর উপাখ্যান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হিন্দুদের একাধিক পুরাণে ও লোককথায়। ব্রহ্মার মানসপুত্র দক্ষ প্রজাপতির ছিল আট মেয়ে। তাঁদের মধ্যে সবার বড়ো ছিলেন সতী। দক্ষ সতীকে শিবের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। শিব শ্বশুরকে যথোচিত সম্মান করতেন না। বরং শ্বশুরের সামনেই তাঁর অশেষ গুণাবলির নিদর্শন স্থাপন করতেন। এজন্য দক্ষও তাঁর এই জামাইটির প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না। সঙ্গে সঙ্গে সতীও হয়ে উঠেছিলেন বাবার বিশেষ অনাদরের পাত্রী। দক্ষ তাঁর অন্য মেয়ে-জামাইদের বাড়িতে ডাকতেন। কিন্তু শিব-সতীকে কখনই ডাকতেন না। সতীর বিয়ের কিছুদিন পরে দক্ষ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। যথারীতি সেই যজ্ঞে তিনি অন্যান্য মেয়ে-জামাইদের আমন্ত্রণ জানালেন; শুধু ডাকলেন না শিব-সতীকে। সতী লোকমুখে জানলেন বাবার যজ্ঞ আয়োজনের খবর। তিনিও যজ্ঞস্থলে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। শিব বারণ করলেন। সতী শুনলেন না। অনাহত হয়ে সটান যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে দক্ষকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘বাবা, দেবাদিদেব মহাদেব কেন এই যজ্ঞে আমন্ত্রিত হননি?’ দক্ষ উত্তরে বললেন, ‘শিব সংহারের দেবতা। তাই তিনি অমঙ্গল বয়ে আনতে পারেন। তাছাড়া তাঁর বেষভূষাও ভদ্রজনোচিত নয়। তিনি শ্মশানচারী। ভূতপ্রেত তাঁর নিত্যসঙ্গী। সেই সব নগ্ন অনুচরবৃন্দের সম্মুখে তিনি নানান কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে থাকেন। তাঁকে নিমন্ত্রণ করলে সমবেত সুধী দেবমণ্ডলীর সামনে আমাকেও অপ্রস্তুত হতে হবে। সেই কারণেই শিবকে এই যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করা হয়নি।’ মঙ্গলময় জগদ্‌গুরু শিব। তায় তিনি তাঁর প্রাণের ঠাকুর। বাপের মুখে পতিনিন্দা সতীর প্রাণে শেলের মতো বিঁধল। যজ্ঞাগ্নিতে সতী-দেহ আহুতি দিলেন শিবানী। সতীর দেহত্যাগের সংবাদ পৌঁছালো দেবাদিদেবের কানে। ক্রোধে উন্মত্ত দেবাদিদেব বীরভদ্র, ভদ্রকালী প্রমুখ অনুচরবৃন্দকে দিয়ে দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করালেন। কন্যার দেহত্যাগের কারণ দক্ষের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। তারপর সতীর অর্ধদগ্ধ দেহ কাঁধে তুলে উন্মত্তের মতো ছুটে বেড়াতে লাগলেন এলোক থেকে সেলোক। ত্রিভুবন ধ্বংস হওয়ার জোগাড় হল তাঁর ক্রোধের তেজে। তাই আসরে নামতে হল বিষ্ণুকে। সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে ছড়িয়ে দিলেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। সতীদেহের অন্তর্ধানে শান্ত হলেন শিব। বসলেন মহাধ্যানে।
এদিকে সতীর দেহের খণ্ডগুলি ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে জন্ম দিল এক এক মহাপীঠের। শক্তিপীঠগুলির সংখ্যা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। পীঠনির্ণয় ও তন্ত্রচূড়ামণি মতে পীঠের সংখ্যা ৫১। শিবচরিত মতে ৫১ পীঠ ও ৫১ উপপীঠ। আবার সর্বশ্রেষ্ঠ শাক্ত পুরাণ দেবীভাগবত মতে ১০৮ পীঠ। বিমলা শক্তিপীঠের উল্লেখ বেশ কয়েকটি প্রধান গ্রন্থে পাওয়া যায়। আবার এই পীঠকে একাধিক নামেও চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা যায়।
তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থের ‘পীঠনির্ণয়’ বা ‘মহাপীঠনির্ণয়’ অংশে উৎকলের বিরজা ক্ষেত্রকে শক্তিপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই পীঠের শক্তি বিমলা ও ভৈরব জগন্নাথ। সতীর নাভি এখানে পড়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে এই গ্রন্থে। তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থেই অন্য একটি অধ্যায়ে অবশ্য বিমলাকে উপপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এখানে সতীর উচ্ছিষ্ট পড়েছিল। তন্ত্রচূড়ামণি মন্দিরের অবস্থান উল্লেখ করতে গিয়ে ‘নীলাচল’ কথাটির উল্লেখ করেছে। নীলাচল বা নীলপর্বতের উল্লেখ শিবচরিত গ্রন্থেও পাওয়া যায়। এই গ্রন্থেও বিমলা উপপীঠ। এখানকার শক্তি বিমলা ও ভৈরব জগন্নাথ। উল্লেখ্য, নীলাচল নামটি জগন্নাথ ক্ষেত্রের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত। সতীর উচ্ছিষ্ট পড়ার ঘটনার সঙ্গে জগন্নাথের উচ্ছিষ্ট ভোগে বিমলার পূজার কোনো যোগ থাকাও অসম্ভব নয়। তবে সেসব গবেষকদের আলোচনার বিষয়।
ফিরে আসি অন্যান্য তন্ত্র ও পুরাণ গ্রন্থগুলির আলোচনায়। কুব্জিকাতন্ত্র বলে, বিমলা ৪২টি সিদ্ধপীঠের একটি। এখানে সাধনা করলে সিদ্ধাই নামে এক ধরনের অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করা সম্ভব। দেবীভাগবত পুরাণপ্রাণতোষিণী তন্ত্র ও বৃহৎ নীলতন্ত্র মতে, বিমলা ১০৮ শক্তিপীঠের অন্যতম। দেবীপুরাণ মতে, এখানে পড়েছিল সতীর পা। মৎস্যপুরাণ মতে, পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের বিমলা একটি শক্তিপীঠ। বামনপুরাণ মতেও এটি একটি মহাতীর্থ। মহাপীঠ নিরুপণ গ্রন্থে বিমলা ও জগন্নাথকে এই তীর্থের পীঠদেবতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাশক্তির ১০৮ পৌরাণিক নামের তালিকা নামাষ্টত্তরশত গ্রন্থেও পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের বিমলার উল্লেখ পাওয়া যায়।
এখানে একটি প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক। ‘ভৈরব’ শব্দটি ও শাক্ত-তান্ত্রিক শক্তিপীঠের ভৈরব ধারণাটির সঙ্গে সাধারণত যে দেবতার সম্পর্ক তিনি দেবাদিদেব মহাদেব। নারায়ণ বা কৃষ্ণ নন। রামানুজী বিশিষ্টাদ্বৈত বা চৈতন্য-অনুসারী গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে পুরীর জগন্নাথ নারায়ণ বা কৃষ্ণের স্বরূপ। বিভিন্ন শাস্ত্রেও দেবী বিমলাকে কাত্যায়নী, দুর্গা, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী বা একানংশা দেবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নারায়ণ-পত্নী লক্ষ্মী বা কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধার সঙ্গে বিমলার কোনো সাদৃশ্য আদৌ দেখা যায় না। তবে কেন জগন্নাথকে ভৈরব বলা হল? কেনই বা তিনি দুর্গা-স্বরূপা বিমলার ভৈরব হলেন?
এর দুটি ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। একটি অদ্বৈত একেশ্বরবাদী ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা অনুসারে, শিব ও বিষ্ণু অভিন্ন। তাই শিবশক্তি দুর্গা ও বিষ্ণুশক্তি লক্ষ্মীও অভিন্না। সেই অর্থেই জগন্নাথ বিমলার ভৈরব। তবে এই ব্যাখ্যা ততটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, বিমলার সঙ্গে  শৈব-তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের যোগ যতখানি, অদ্বৈত সম্প্রদায়ের যোগ ততখানি নয়। তন্ত্র মতে, জগন্নাথ নারায়ণ বা কৃষ্ণের নয়, শিবের রূপ। সেই জন্যই তিনি শিব-ভৈরব। মনে হয়, এই কারণেই তন্ত্রগ্রন্থগুলিতে জগন্নাথকে ভৈরব আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আর তাই শাক্ত বিশ্বাসে দেবী বিমলা হয়ে উঠেছেন পুরুষোত্তম শক্তিপীঠের প্রধান দেবী তথা জগন্নাথ মন্দিরের রক্ষয়িত্রী।
এ তো গেল শাস্ত্রের কথা। কিন্তু ইতিহাস কী বলে?
ইতিহাস বলে, বিমলা মন্দিরের ইতিহাস সম্ভবত বৈষ্ণব জগন্নাথ-কাল্টের চেয়েও প্রাচীন। জগন্নাথ মন্দিরের বর্তমান কাঠামোটি খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর পরে নির্মিত। অথচ বর্তমান বিমলা মন্দিরটি খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের রাজত্বকালে নির্মিত। তাও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ফলে জানা গিয়েছে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত আদি বিমলা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপরই গড়ে উঠেছে নবম শতাব্দীর এই মন্দিরটি। জগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রোহিণীকুণ্ডের পাশে অবস্থিত বিমলা মন্দিরের সঙ্গে মন্দির চত্বরের মুক্তিমণ্ডপের কাছে অবস্থিত নৃসিংহ মন্দিরের স্থাপত্যগত মিলটি বেশ লক্ষণীয়। মাদলা পাঁজি বলছে, দক্ষিণ কোশলের সোমবংশী রাজবংশের রাজা যযাতি কেশরী এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা।  উল্লেখ্য, এই বংশের রাজা প্রথম যযাতি (খ্রিস্টীয় ৯২২–৯৫৫) ও দ্বিতীয় যযাতি (খ্রিস্টীয় ১০২৫–১০৪০) উভয়েই “যযাতি কেশরী” নামে পরিচিত ছিলেন। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী–বিশেষত পার্শ্বদেবতাদের মূর্তি ও মূল মূর্তিটির পিছনের পাথরের খণ্ডটি সোমবংশী শৈলীর নিদর্শন বহন করে। হয়তো এগুলি আদি মন্দিরেরই অংশ ছিল। তাই বলাই যায়, চত্বরের প্রধান মন্দির জগন্নাথ মন্দিরের তুলনায় দেবী বিমলার মন্দির প্রাচীনতর।
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য পুরীতে গোবর্ধন মঠ স্থাপন করেছিলেন বিমলাকে প্রধান দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। প্রথা অনুসারে, আজও গোবর্ধন মঠের অধ্যক্ষ পুরীর শঙ্করাচার্য বিমলা মন্দিরের প্রসাদ হিসেবে এক থালা মহাপ্রসাদ ও এক থালা খিচুড়ি ভোগ রোজ পেয়ে থাকেন। দ্য জগন্নাথ টেম্পল অ্যাট পুরী গ্রন্থের লেখক স্টারজার মতে, প্রাচীনকালে জগন্নাথ মন্দির ছিল ত্রিমূর্তি অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবপূজার কেন্দ্র। এই তিন দেবতার শক্তি তথা হিন্দুধর্মের প্রধান তিন দেবী সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পার্বতীও তাই পূজিত হতেন জগন্নাথ মন্দিরে। তার মধ্যে দেবী পার্বতীর পূজা হত বিমলা রূপে। খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত পুরীতে শ্রীবিদ্যা উপাসনার প্রাবল্য লক্ষিত হয়েছে। পরবর্তীকালে বৈষ্ণবধর্ম জগন্নাথ মন্দির চত্বরে প্রাধান্য বিস্তার করে। কমে যায় শ্রীবিদ্যা ও শৈব-তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের প্রভাব। তবে এই প্রভাব একেবারেই অবলুপ্ত হয়নি। তান্ত্রিক পঞ্চমকার উপচারের বদলে বিমলা মন্দিরে নিরামিশ ভোগ ও দেবদাসী নৃত্যের প্রথা চালু হয়েছিল। তবে মাছভোগ দেবার প্রথাটি বজায় ছিল। রাজা নরসিংহদেব (শাসনকাল ১৬৩২–৪৭ খ্রিস্টাব্দ) মন্দিরে মাছ ও মাংস ভোগের প্রথা বন্ধ করে দেন। পরবর্তীকালে অবশ্য সেই প্রথা আবার চালু হয়। বর্তমানে বিমলা মন্দিরের জন্য সাধারণত আলাদা ভোগ রান্না করা হয় না। জগন্নাথের নিরামিশ ভোগই দেবী বিমলাকে নিবেদন করা হয়। শুধু দুর্গাপূজার সময় দেবীকে আমিষ ভোগ দেবার প্রথা রয়েছে। এই সময় খুব ভোরে গোপনে মন্দিরে পাঁঠাবলিও হয়। স্থানীয় মার্কণ্ড মন্দিরের জলাশয় থেকে মাছ ধরে এনে রান্না করে বিমলাকে নিবেদন করা হয়। পূজা হয় তন্ত্র মতে। এই সব অনুষ্ঠান ভোরে জগন্নাথ মন্দিরের দরজা খোলার আগেই সেরে ফেলা হয়। বৈষ্ণব ও স্ত্রী ভক্তদের এই সময় বিমলা মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। অনুষ্ঠানের অল্প কয়েকজন দর্শকই শুধু “বিমলা পারুষ” বা বিমলার আমিষ ভোগ পান। দেবী বিমলার ভক্তদের বিশ্বাস, দুর্গাপূজায় দেবী উগ্রমূর্তি ধারণ করেন। সেই সময় তাঁকে শান্ত করতে আমিষ ভোগ দিতেই হয়। যদিও এই মন্দিরে পশুবলি ও আমিষ ভোগ নিবেদন নিয়ে বৈষ্ণবদের আপত্তিও সুবিদিত।
বেলেপাথর ও ল্যাটেরাইটে নির্মিত বিমলা মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীটি কলিঙ্গ স্থাপত্যশৈলীর দেউল রীতির নিদর্শন। মন্দিরের চারটি অংশ: বিমান (গর্ভগৃহ যে অংশে অবস্থিত), জগমোহন (সভাঘর), নাটমণ্ডপ (উৎসবাদির স্থান) ও ভোগমণ্ডপ (ভোগ ও বিনোদনের স্থান)। এর মধ্যে বিমান অংশটি রেখ দেউল। এর আকার শম্বুকাকৃতির চিনির ডেলার মতো। বিমলা মন্দিরের বিমানটির উচ্চতা ৬০ ফুট। গায়ে নানারকম ছবি খোদাই করা। কেন্দ্রীয় গর্ভগৃহে রাখা আছে দেবী বিমলার মূর্তিটি। দেবী এখানে চতুর্ভূজা। তাঁর তিন হাতে জপমালা, বরমুদ্রা ও অমৃতকুম্ভ। চতুর্থ হাতের বস্তুটি ঠিক কী, তা নিয়ে মতান্তর দেখা যায়। তবে দেবী দুর্গার যে মূর্তি আমরা সচরাচর দেখতে অভ্যস্থ, দেবী বিমলার মূর্তি আদৌ সে রকম নয়। শুধু দেবী পার্বতীর দুই সখি জয়া ও বিজয়াকে দেবী বিমলার দুই পাশে দেখা যায়। মূর্তির উচ্চতা ৪ ফুটের কিছু বেশি।
বিমানের বাইরে জগমোহন, নাটমণ্ডপ ও ভোগমণ্ডপও নানারকম খোদাইচিত্রে শোভিত। বিমানে তিনটি কুলুঙ্গি আছে। তার একটিতে অষ্টভূজা মহিষমর্দিনী ও আর একটিতে ষড়ভূজা চামুণ্ডার মূর্তি দেখা যায়। তৃতীয় কুলুঙ্গিটি খালি। সম্ভবত সেখানকার দেবীমূর্তিটি চুরি গিয়েছে। জগমোহনের বৈশিষ্ট্য এর পিরামিড-আকৃতির ছাদ। নাটমণ্ডপে দশমহাবিদ্যা সহ মোট ষোলোজন হিন্দু দেবীর মূর্তি অঙ্কিত আছে। ভোগমণ্ডপের কুলুঙ্গিতে আছে অষ্টভূজ গণেষ ও ষড়ানন কার্তিকের মূর্তি। এছাড়া ভোগমণ্ডপের প্রবেশপথের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দেবী বিমলার বাহন গজসিংহ – পরাজিত হাতির উপর দাঁড়ানো বিজয়দর্পে গর্বিত এক সিংহ।
২০০৫ সালে বিমলা মন্দির সংস্কার করা হয়েছে। বর্তমানে এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ভুবনেশ্বর সার্কেল।
বিমলা মন্দিরের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা। প্রতি বছর আশ্বিন মাসে ষোলোদিন ধরে মন্দিরে উদযাপিত হয় দুর্গাপূজা। পুরীর রাজা বিজয়াদশমীর দিন বিমলাকে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার রূপে পূজা করেন। এই মন্দিরের দুর্গাপূজার সবচেয়ে পুরনো উল্লেখটি পাওয়া যায়এখন নতুন দিল্লিতে রাখা কোণার্ক শিলালিপিতে (খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী)। এই শিলালিপির তথ্য অনুসারে, রাজা প্রথম নরসিংহদেব (রাজত্বকাল: ১২৩৮–১২৬৪) বিজয়াদশমীর দিন দুর্গা-মাধব (বিমলা-জগন্নাথ) পূজা করেছিলেন। হিন্দুধর্মের সনাতন বিশ্বাস, মেয়েরা কোমলস্বভাব। তাই বিমলার উগ্রমূর্তি মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা আজও দেখতে দেওয়া হয় না মেয়েদের।
বিমলা মন্দিরের একটি বৈশিষ্ট্য হল, জগন্নাথের প্রসাদী নারকেল বাটা, পনির ও মাখন দিয়ে শুকনো ভাত দিয়ে দেবী বিমলার নিত্যভোগের ব্যবস্থা। দুর্গাপূজার আমিষ ভোগ রান্নার ব্যবস্থা ছাড়া বিমলা মন্দিরের জন্য পৃথক ভোগ রান্নার ব্যবস্থা নেই। উচ্ছিষ্ট ভোগে হিন্দুধর্মে দেবদেবীর পূজা নিষিদ্ধ। তবে বিমলা মন্দিরে কেন এই ব্যবস্থা? ওড়িশায় একটি লোকশ্রুতি আছে এই নিয়ে। বৈকুণ্ঠে নারায়ণ-দর্শনে গিয়েছেন দেবাদিদেব মহাদেব। নারায়ণ তখন খেতে বসেছেন। মহাদেব দেখলেন, নারায়ণের থালা থেকে তাঁর ভোজ্যের কয়েক টুকরো উচ্ছিষ্ট পড়েছে মাটিতে। প্রসাদজ্ঞানে সেই উচ্ছিষ্ট তুলে মুখে দিলেন মহাদেব। সেসময় তাঁর অনবধানে কিছুটা লেগে রইল তাঁর দাড়িতে। কৈলাশে ফেরার পর মহাদেব দেখলেন, তাঁর পথ চেয়ে অপেক্ষা করে আছেন দেবর্ষি নারদ। নারদ দেখলেন মহাদেবের দাড়িতে লেগে আছে ভোজনাবশেষ। তিনি জানতেন, মহাদেব গিয়েছিলেন বৈকুণ্ঠে নারায়ণ-সন্দর্শনে। দুইয়ে দুইয়ে চার করলেন নারদ। তাঁর বুঝতে দেরি হল না, মহাদেব যাঁর শ্রেষ্ঠ ভক্ত, সেই নারায়ণেরই উচ্ছিষ্ট লেগে রয়েছে মহাদেবের দাড়িতে। তিনি চকিতে সেই উচ্ছিষ্ট তুলে নিয়ে মুখে দিলেন। ঘটনাটি নজর এড়ালো না শিবপত্নী পার্বতীর। ক্ষুণ্ণ হলেন তিনি। সোজা চলে এলেন বৈকুণ্ঠে। নালিশ জানালেন, নারায়ণ-প্রসাদে তাঁর ন্যায্য পাওনা থেকে দেবর্ষি তাঁকে বঞ্চিত করেছেন। তখন পার্বতীকে শান্ত করে নারায়ণ বললেন, “দেবী, দুঃখ কোরো না। কলিযুগে বিমলা রূপে নিত্য আমার প্রসাদ পাবে তুমি।” ভক্তেরা বলেন, সেই থেকে পুরীর মন্দিরে জগন্নাথের প্রসাদী অন্নে বিমলার পূজার নিয়ম।  উল্লেখ্য, জগন্নাথের প্রসাদ বিমলাকে উৎসর্গ করার পরই তা পায় মহাপ্রসাদের মর্যাদা।
শাক্ত সম্প্রদায়ের কাছে বিমলা মন্দির একটি মহাতীর্থ। ওড়িশাবাসী শাক্তদের কাছে বিমলা প্রধান শাক্ততীর্থ। তান্ত্রিকদের কাছে তো এই মন্দিরের গুরুত্ব মূল জগন্নাথ মন্দিরের চেয়েও বেশি।  জগন্নাথ মন্দিরের প্রথা অনুসারে, মূল মন্দিরে জগন্নাথকে পূজা করার বিমলাকে পূজা করা হয়।  প্রতিদিন এই মন্দিরের গর্ভমন্দির মুখরিত হয় শ্রীশ্রীচণ্ডী, আদি শঙ্করাচার্যের ‘দেব্যাপরাধক্ষমাপণ স্ত্রোত্র’ ও পুরুষোত্তম রক্ষিতের ‘বিমলাষ্টক স্তোত্রে’র সুরে। সন্তান আকুতি জানান, “মা, তোমার চরণসেবা করিনি কোনোদিন। কোনোদিন কিছুই ভালবেসে তুলে দিই নি তোমার হাতে। তবু আমাকে তোমার স্নেহের ছায়া থেকে কোনোদিন বঞ্চিত করোনি তুমি। আমি জানি, কুপুত্র জন্মায়, কিন্তু কুমাতা কখনও হয় না। আমার মতো পাপী আর কেউ নেই। তোমার মতো পাপঘ্নীও কেউ নেই। তাই হে জগজ্জননী, এরূপ জেনে যা উচিত তাই করো!”

শেয়ার করুন

0 মন্তব্য(গুলি):