মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব (শ্রীকৃষ্ণের Sree Krishna)

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথিকে কেন্দ্র করেই শুভ জন্মাষ্টমী পালন করা হয়। এ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন মন্দিরে পূজা অর্চনা, তারকব্রহ্ম হরিনাম সংকীর্তন ও তারকব্রহ্ম নামযজ্ঞেরও আয়োজন করা হয়। ঘরে ঘরে ভক্তরা উপবাস থেকে জন্মাষ্টমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা ও পূজা, গীতাযজ্ঞ, জন্মাষ্টমী মিছিল, কৃষ্ণপূজা, পদাবলি কীর্তন করে থাকেন।


ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল ৩২২৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ১৮ জুলাই। দ্বাপর যুগের এই দিনে পাশবিক শক্তি যখন সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই অসুন্দর, অসুর ও দানবীয় পাশবিক শক্তিকে দমন করে মানবজাতিকে রক্ষা এবং শুভশক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছিল পূর্ণ অবতার রূপে। পূর্ণ অবতার বলতে ভগবান বিষ্ণুর প্রত্যক্ষ উপস্থিতিকে নির্দেশ করে এবং ঈশ্বরের শক্তি ও গুণাবলি প্রদর্শন করাকে বোঝানো হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর, ভগবান, গোবিন্দ, পরমেশ্বর প্রভৃতি নামে অভিহিত করে।
হিন্দু পঞ্জিকা মতে, সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয়, তখন জন্মাষ্টমী পালিত হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মতে, প্রতিবছর মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোনো একসময়ে এ উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ বছর ১৭ আগস্ট ২০১৪ জন্মাষ্টমী পালন করা হচ্ছে।
গীতার কথামতো ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের বৃদ্ধির তাৎপর্য হলো—ভগবদ্ প্রেমী, ধর্মাত্মা, সদাচারী, নিরপরাধ জীবাত্মার ওপর নাস্তিক, পাপী, দুরাচার, বলবান ব্যক্তিদের অত্যাচার বৃদ্ধি পাওয়া এবং মানুষের মধ্যে সদ্গুণ সদাচার অত্যন্ত কমে গিয়ে দুর্গুণ-দুরাচারের অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়াকে বোঝানো হয়। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন, ‘আমি জন্মহীন, অব্যয় আত্মা, সর্বভূতের ঈশ্বর, শাসক, স্রষ্টা, নিয়ামক হয়েও নিজ (স্বাভাবিক) অনির্বচনীয়া মায়াশক্তিতে আশ্রয় করে আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি (দেহ ধারণ করি)।’
শ্রীকৃষ্ণের প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় বৈদিক সাহিত্যে। ঋদ্বেদে একাধিকবার শ্রীকৃষ্ণের উল্লেখ আছে। শ্রীকৃষ্ণকে দেবকীপুত্র বলা হয়। মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত এবং বৈষ্ণবকাব্যে যে কৃষ্ণের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, তাঁর আবির্ভাব দ্বাপর যুগে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পিতার নাম বসুদেব ও মাতার নাম দেবকী। তিনি পিতামাতার অষ্টম পুত্র। রাজা উগ্রসেনের পুত্র কংসের কারাগারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন। পিতা বসুদেব শ্রীকৃষ্ণের জীবন বিপন্ন জেনে জন্মরাত্রেই দৈবসহায়তায় কারাগার থেকে তাঁকে গোকুলে যশোদা ও নন্দের কাছে রেখে আসেন। শ্রীকৃষ্ণের জন্মের রাত ছিল গভীর অন্ধকার। তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে বসুদেব দেখলেন শিশুটি চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করে আছেন। দেখে তিনি বুঝতে পারলেন জগতের মঙ্গলার্থে পূর্ণবৃক্ষ নারায়ণ তাদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। বসুদেব করজোড়ে প্রণাম ও বন্দনার পর দেবকী প্রার্থনা করলেন। শ্রীকৃষ্ণ একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করলেন। বাল্যকাল থেকেই কৃষ্ণ তাঁর অলৌকিক শক্তির প্রমাণ দিয়েছিলেন পুতনাবধ, দামবন্ধন লীলা, কলীয়দমন, গোর্বধন ধারণ প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। নিপীড়িত মানুষ মুক্তির আশায় কানুর তথা কৃষ্ণের অনুসারী হয়ে ওঠে এবং ক্রমান্বয়ে কংসবধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। অবশেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংস রাজাকে বধ করেন।
শ্রীকৃষ্ণের ভগবত্তা ও জন্মাষ্টমীর তাৎপর্য হলো: ১. বসুদেব যখন ছোট শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে বৃন্দাবন যাচ্ছিলেন তখন কারাগার আপনি আপনিই খুলে গেল। প্রহরীসহ সব জীব সেই রাতে ছিল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। যমুনা বসুদেবকে যাওয়ার পথ করে দিল। প্রকৃতপক্ষে এই সবকিছুই কৃষ্ণের ভগবত্তা। [শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে (২/৮৮] ২. ‘ভগবানের সমস্ত অবতারেরা হচ্ছেন পুরুষাবতারদের অংশ অথবা কলা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান।’ ৩. মহাপ্রভু বলেছেন, ঈশ্বর পরম কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান। শাস্ত্রে তাঁর ছয়টি রূপের কথা বলা হয়েছে—ব্রহ্মত্ব, ভগবত্ত্ব, জ্ঞেয়, আস্বাদ্য ঐশ্বর্য, মাধুর্য। ৪. ঋদ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১১৬ এবং ১১৭ সুক্তে ঋষি কৃষ্ণের নাম উল্লেখ আছে। ৫. শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর প্রাচীনতম নিদর্শন মথুরার চিত্তশালার খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের অর্ধভগ্ন প্রস্তর ফলকে দেখতে পাওয়া যায়। ৬. বিষ্ণুপুরাণে শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয়েছে, ‘মহাভারত তন্ত্র ধার’।
ঋগবান শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীর জীবকুলের পরম পিতা, পরম সত্তা ও আত্মা। তিনি জগতের গুরু। তিনি পৃথিবীর সব কলুষিত পরিবেশ ও কলুষিত বন্ধন দূর করে এ পৃথিবীর সব জীবের মধ্যে আত্মার বন্ধন সুদৃঢ় করেছেন। তিনি অর্জুনের মাধ্যমে গীতার আঠারোটি অধ্যায়ে জাগতিক জ্ঞান, ধ্যান, কর্ম, বিভূতি, ভক্তি, মুক্তি, মোহ, যশ, খ্যাতি আর অর্থ-বিত্তের মায়াজাল, অন্যায়, অসত্য, পাপ আত্মঅহংকার, মোক্ষ লাভ প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান দান করেছেন। তিনি সব প্রাণীর মধ্যের তমগুণের প্রভাব অর্থাৎ অসৎ কার্য পরিহার করে ন্যায়-সত্য প্রতিষ্ঠা করেন। জীবকুলে তিনি সত্যের বাণী স্থাপন করেছেন। ন্যায়ের পক্ষে ভগবদ্ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে জীবশিক্ষার জন্য বিভিন্ন কর্ম করেন। আগামী দিনে সত্যের পথে চলার মতো আলোকবর্তিকারূপে বিভিন্ন শিক্ষা দিয়ে থাকেন। আজকের এই পুণ্য তিথিতে ভগবানের সঙ্গে আমাদের চিন্ময় সম্পর্ক গড়ে উঠুক, এটাই হোক আমাদের একমাত্র প্রার্থনা।

শেয়ার করুন

0 মন্তব্য(গুলি):