মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০১৯

প্রশ্নঃ কৃষ্ণভক্তকে যোগমায়া দুর্গার পূজা করতে নিষেধ করা হয়েছে, অথচ বৃন্দাবনে কৃষ্ণ ও যোগমায়া ভ্রাতা ও ভগিনীরূপে আবির্ভূত হলেন। ভ্রাতার পূজা করা হবে, কিন্তু ভগিনীর পূজা হবে না কেন?

প্রশ্নঃ কৃষ্ণভক্তকে যোগমায়া দুর্গার পূজা করতে নিষেধ করা হয়েছে, অথচ বৃন্দাবনে কৃষ্ণ ও যোগমায়া ভ্রাতা ও ভগিনীরূপে আবির্ভূত হলেন। ভ্রাতার পূজা করা হবে, কিন্তু ভগিনীর পূজা হবে না কেন?
উত্তরঃ যোগমায়ার পূজা করতে কাউকে কোথাও নিষেধ করা হয়নি। ভক্তরাই যোগমায়ার পূজা করে। অভক্তরা কখনই যোগমায়ার পূজা করে না। অভক্তরা সব সময় মহামায়ার পূজায় আগ্রহী।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা ও বহিরঙ্গা এই উভয় শক্তিরই দুর্গা, মহামায়া প্রভৃতি নাম নানা শাস্ত্রে দেখা যায়। অন্তরঙ্গা শক্তির উপাসনায় কৃষ্ণভক্তি প্রাপ্তি এবং বহিরঙ্গা শক্তির উপাসনায় জড়জাগতিক বৈভব প্রাপ্তি হয়ে থাকে। যিনি যা কামনা করবেন তাঁর সেই শক্তির উপাসনা করা হয়। 'ধন দাও, যশ দাও, পুত্র দাও, সরকারী চাকুরী দাও, সুন্দরী স্ত্রী দাও, ডিগ্রী পাস, জমিজমা ভোগ, রাজত্ব, মন্ত্রীত্ব'---এই রকম কিছু বাসনা নিয়ে দুর্গাপূজা করলে তিনি বহিরঙ্গা মহামায়া রূপে মনোবাসনা পূর্ণ করেন।

শ্রীকৃষ্ণপাদপদ্মের সেবায় উন্মুখী হলে যে শক্তি সহায়তা করেন সেই শক্তিই যোগমায়া, আর কৃষ্ণবহির্মুখ হলে যে শক্তি জড়জাগতিক ভোগ্যবস্তু দিয়ে কৃষ্ণ থেকে ভুলিয়ে রাখতে সহায়তা করেন সেই শক্তিই মহামায়া।

কাত্যায়নী দুর্গারই অন্য নাম। শ্রীবৃন্দাবনের গোপবালিকাগণ যে কাত্যায়নী দেবীর আরাধনা করেছিলেন সেই ক্ষেত্রে তাঁদের আরাধনার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করা। অত্যন্ত সম্মানীয়া মহা প্রজ্ঞাবতী শ্রীবৃন্দাদেবীর নির্দেশে গোপবালিকারা নন্দনন্দন শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করবার আশায় কাত্যায়নী পূজা করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং। তিনি সচ্চিদানন্দময় পুরুষ। গোপকুমারীগণ কোনও বদ্ধ জীবকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য কাত্যায়নী ব্রত করেননি। সেই কাত্যায়নী যোগমায়া।

কিন্তু অভক্তরা অর্থাৎ কৃষ্ণবহির্মুখ ব্যক্তিরা জড়জাগতিক সম্পদ উপভোগের উদ্দেশ্যে দুর্গাপূজা করে, সেই দুর্গা হচ্ছেন মহামায়া। মহামায়ার দেওয়া সম্পদ পরিণামে দুঃখই দান করে। জড়জাগতিক ভোগবাসনার জন্য এই জড় জগৎ থেকে জীব কখনই স্বস্তি লাভ করতে পারে না। মৃত্যুময় ভবচক্র থেকে মুক্তি পেতে পারে না। তাকে জন্মমৃত্যুর চক্রে জন্ম-জন্মান্তর ধরে এই দুঃখময় জড় জগতে বদ্ধ হয়েই থাকতে হয়।

কেউ যদি কৃষ্ণভক্তি আকাঙ্ক্ষী হন তবে কৃষ্ণের পাদপদ্মে শরণাগত হয়ে এই মহামায়ার দুঃখ ও উদ্বেগপূর্ণ জড় জগৎ থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারবেন। এই কথা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উল্লেখ করেছেনঃ
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে॥
"আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তাকে কেউই সহজে অতিক্রম করতে পারে না। কিন্তু যারা আমাতে প্রপত্তি করে তারাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারে।" (গীতা ৭/১৪)

কিন্তু জগতের অসুর প্রকৃতির মানুষেরা দুর্গা বা কালীকে পরম আরাধ্যা রূপে গ্রহণ করে এবং শ্রীকৃষ্ণকে ঐতিহাসিক পুরুষ রূপে কল্পনা করে। আবার অনেকে মনে করে কালীপূজা, দুর্গাপূজা আর কৃষ্ণপূজা একই কথা। এই ধরণের লোকেরা মায়াপহৃত- জ্ঞানাঃ। মহামায়া তাদের জ্ঞান বুদ্ধি অপহরণ করেছেন। কারণ তারা কৃষ্ণের চরণে অপরাধী। কিন্তু কেউ যদি কৃষ্ণপূজা করে, তবে তাঁর প্রতি সমস্ত দেব-দেবী প্রসন্ন হন বলে শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে।
(ভাগবত ৪/৩১/১৪ দ্রষ্টব্য)
কৃষ্ণভক্তি আছে যার সর্বদেব বন্ধু তার॥

জড় জগতে মহামায়া দুর্গাদেবী হচ্ছেন চিৎজগতের যোগমায়ার ছায়া স্বরূপিনী।
শ্রীব্রহ্মা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্তুতি করছেন---
সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়সাধনশক্তিরেকা
ছায়েব যস্য ভুবনানি বিভর্তি দুর্গা।
ইচ্ছানুরূপমপি যস্য চ চেষ্টতে সা
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি॥
"ভগবানের স্বরূপ শক্তি বা চিৎ শক্তির ছায়া স্বরূপা, জড় জগতের সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় সাধনকারিণী মায়াশক্তিই ভুবনপূজিতা দুর্গা। তিনি যাঁর ইচ্ছানুরূপ চেষ্টা করেন, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।" (ব্রহ্মসংহিতা ৪৪)

শেয়ার করুন

0 মন্তব্য(গুলি):