সত্য যুগ
সত্য যুগ হলো হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, চার যুগের প্রথম যুগ। অন্য যুগ গুলো হলো ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ ও কলি যুগ।
বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষে তৃতীয়া তিথিতে রবিবারে সত্যযুগের উৎপত্তি। এর পরিমাণ ১৭,২৮,০০০ বছর। অবতার সংখ্যা চার। মৎস্য (মাছ), কুর্ম (কুমির), বরাহ (শুকর), নৃসিংহ (মানুষ ও সিংহের সমন্বিত রূপ)। ছয় জন শাসক। বলি, বেণ, মান্ধাতা, পুরোরবা, ধুন্ধুমার, কাত্তাবীর্য্য অর্জুন। শুধু পুণ্য ছিল, পাপ ছিল না। প্রাণ ছিল মজ্জায়। মৃত্যু ছিল ইচ্ছাধীন। সোনার পাত্র ব্যবহার করা হত। বেদ ছিল সামবেদ। তীর্থ ছিল পুষ্কর তীর্থ। তারক ব্রহ্মনাম ছিল- নারায়ণ পরা বেদা, নারায়ণ পরা অক্ষরা, নারায়ণ পরা মুক্তি, নারায়ণ পরা গতি। অর্থাৎ নারায়ণ পরম বেদ, নারায়ণ পরম অক্ষর, নারায়ণ পরম মুক্তি, নারায়ণ পরম গতি।
ত্রেতা যুগ
ত্রেতা যুগ হলো হিন্দুধর্ম অনুযায়ী, চার যুগের দ্বিতীয় যুগ। ত্রেতা মানে সংস্কৃত ভাষায় তৃতীয়। প্রথম যুগ হলো সিদ্ধ নৈতিকতার সত্য যুগ এবং দ্বিতীয়টি দ্বাপর যুগ। কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের নবমী তিথিতে সোমবারে ত্রেতা যুগের উৎপত্তি। এর পরিমাণ ১২,৯৬,০০০ বছর। এই যুগের পালনকর্তা বিষ্ণুর তিন অবতার যথাক্রমে বামন, পরশুরাম এবং রাম। পুণ্য তিন ভাগ, পাপ এক ভাগ। সূর্য বংশের শাসক- ব্রহ্ম, মরীচি, কাশ্যপ, সাবর্ণিক, মনু, ধনু, সুষেণ, হরিদাস, যৌবনাশ্ব, মুচুকুন্দ, শতবাহু, বেন, পৃত্থু, ইক্ষাকু, দ্যোতকর, কৎসর্প, শ্রেষ্ঠধর, ককুৎস্থ, শতঞ্জীব, দণ্ড, হরিষ, বিজয়, হরিশচন্দ্র, রোহিতাশ্ব, মৃত্যুঞ্জয়, মহাপদ্ম, ত্রিশঙ্কু, উচ্চাঙ্গদ, মরুৎ, অনরণ্য, বিকর্ণবাহু, সগর, অংশুমান, অসমঞ্জা, ভগীরথ, অশ্বঞ্জয়, মণি দীলিপ, রঘু, অজ, দশরথ, শ্রীরাম, লব, কুশ। প্রাণ ছিল অস্থিতে। বেদ ছিল ঋগ্বেদ। রূপার পাত্র ব্যবহার করা হত। তীর্থ ছিল নৈমিষ অরণ্য। তারক ব্রহ্মনাম- রাম নারায়ণানন্ত মুকুন্দ মধুসুদন। কৃষ্ণ কেশব কংসারে হরে বৈকুণ্ঠ বামন। অর্থাৎ রাম নারায়ণ অনন্ত মুকুন্দ মধুসুদন কৃষ্ণ কেশব কংস অরি হরি বৈকুণ্ঠ বামন।
দ্বাপর যুগ
দ্বাপর যুগ হলো হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, চার যুগের তৃতীয় যুগ।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে বৃহস্পতিবারে দ্বাপর যুগের উৎপত্তি। এর পরিমাণ ৮,৬৪,০০০ বছর। অবতার সংখ্যা দুই। শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ। পুণ্য অর্ধেক, পাপ অর্ধেক। শাসক ছিল-শাল্ব, বিরাট, হংসধ্বজ, কুশধ্বজ, ময়ুরধ্বজ, বভ্রুবাহন, রুক্ষাঙ্গদ, দুর্যোধন, যুধিষ্ঠির, পরিক্ষিৎ, জনমেজয়, বিষকসেন, শিশুপাল, জরাসন্ধ, উগ্রসেন, কংস। প্রাণ ছিল রক্তে। বেদ ছিল যজুর্বেদ। তামার পাত্র ব্যবহার করা হত। তীর্থ ছিল কুরুক্ষেত্র। তারক ব্রহ্মনাম- হরে মুরারে মধুকৈটভারে গোপাল গোবিন্দ মুকুন্দ শৌরে যজ্ঞেশ নারায়ণ কৃষ্ণ বিষ্ণো নিরাশ্রয় মাং জগদীশ রক্ষো। অর্থাৎ হরি মুরারী মধু কৈটভ অরি, গোপাল গোবিন্দ মুকুন্দ শৌরি, নারায়ণ কৃষ্ণ বিষ্ণু যজ্ঞেশ, নিরাশ্রয় আমাকে রাখ জগদীশ।
কলি যুগ
কলি যুগ , আক্ষরিকভাবে “কলির যুগ”, বা “পাপের যুগ”) হলো হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, চার যুগের শেষ যুগ। অন্য যুগ গুলো হলো সত্য যুগ,ত্রেতা যুগ, ও দ্বাপর যুগ।
মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের পুর্ণিমা তিথিতে শুক্রবারে কলিযুগের উৎপত্তি। এর পরিমাণ ৪,৩২,০০০ বছর। পুণ্য এক ভাগ, পাপ তিন ভাগ। অবতার কল্কি। মানুষের আয়ু একশ বিশ বছর প্রায়। নিজের হাতে সাড়ে তিন হাত নিজের শরীরের আয়তন। প্রাণ অন্নে। তীর্থ গঙ্গা। সব পাত্র ব্যবহার করা হয়। ধর্ম সংকোচিত। মানুষ তপস্যাহীন, সত্য থেকে দূরে অবস্থানরত। রাজনীতি কুটিল। শাসক ধনলোভী। ব্রাহ্মণ শাস্ত্রহীন। পুরুষ স্ত্রীর অনুগত। পাপে অনুরক্ত। সৎ মানুষের কষ্ট বৃদ্ধি। দুষ্টের প্রভাব বৃদ্ধি। তারক ব্রহ্মনাম- হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।
সময় পরিমাণ
বেদব্যাস রচিত বিষ্ণু পুরাণ বলা হয়েছে যে কৃষ্ণের পৃথিবী ত্যাগ করে স্বর্গারোহণের সময় থেকে পৃথিবীতে কলি যুগের সূচনা হয়েছে।
মনু সংহিতায় বলা হয়েছে যে মানুষের এক বছরে দেবতাদের এক দিবারাত্র হয়। উত্তরাযণ দেবতাদের দিন এবং দক্ষিণায়ন তাদের রাত। ৪,০০০ (চার সহস্র) দৈবপরিমাণ বছরে সত্য বা কৃত যুগ হয় এবং ওই য়ুগের আগে ৪০০(চার শত) বছর সন্ধ্যা ও পরে ৪০০ বছর সন্ধ্যাংশ হয়। পরবর্তী যুগগুলিতে (ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি) যুগের পরিমাণ ১,০০০(এক হাজার) বছর করে এবং সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ ১০০(এক শত) বছর করে কমে যায়। এই হিসাবে ১০০০ দৈব বছরে কলিযুগ হয় এবং এর সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ ১০০ বছর হয়; অর্থাৎ ১২০০ দৈব বছরে কলি যুগ সম্পূর্ণ হয় সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ সহ । ১ দৈববছর যদি ৩৬০ দৈব দিনে হয় তবে কলিযুগ সম্পূর্ণ হতে সময় লাগবে ১২০০x৩৬০=৪,৩২,০০০ মনুষ্য বা সৌর বছর।
মানুষের আয়ুকাল
মনু সংহিতায় বলা হয়েছে যে সত্যযুগে মানুষের আয়ু ছিল ৪০০(চার শত) বছর। পরবর্তী ৩ যুগে ১০০ বছর করে পরমায়ু কমে যায়। এই হিসেবে কলি যুগে মানুষের পরমায়ু ১০০ বছর।
লক্ষণ
”’বিষ্ণু পুরাণ”’ অনুযায়ী ব্রহ্মা সত্যযুগে সমস্ত সৃষ্টিকর্ম করেন এবং কলিতে সমস্ত সৃষ্টি উপসংহার করেন। বিষ্ণু পুরাণ মতে কম ধনের অধিকারী হয়ে মানুষ এ যুগে বেশী গর্ব করবে। ধর্মের জন্য অর্থ খচর করবে না। ধর্মগ্রন্থের প্রতি মানুষের আর্কষন থাকবে না। মাতাপিতাকে মানবে না। পুত্র পিতৃহত্যা বা পিতা পুত্র হত্যা করতে কুন্ঠিত হবে না। মানুষ বৈদিক ক্রিয়া আচার সমূহ করবে না। ধর্মানুসারে কেউ বিবাহিত থাকবে না। স্ত্রীলোকরা কেবল চুলের বাহদুরী করেই নিজেকে সুন্দরী বলে মনে করবে। ধনহীন পতিকে স্ত্রীরা ত্যাগ করবে। আর ধনবান পুরুষরা সেই স্ত্রীগণের স্বামী হবে। কলিযুগে ধর্মের জন্য ব্যয় না করে কেবল গৃহাদি নির্মাণে অর্থ ব্যয় করবে। মানুষ পরকালের চিন্তা না করে কেবল অর্থ উর্পাজনের চিন্তাতেই নিরন্তর নিমগ্ন থাকবে। কলিযুগে নারীরা সাধারনতঃ স্বেচ্ছাচারিণী ও বিলাস উপকরণে অতিশয় অনুরাগিণী হবে এবং পুরুষরা অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন করতে অভিলাষী হবে। সুহ্বদদের প্রার্থনাতে মানুষ নিজের অনুমাত্র স্বার্থ পরিত্যাগ করবেনা। অসমর্থ মানুষরা ধনহীন হয়ে নিরন্তর দুর্ভিক্ষ ও ক্লেশ ভোগ করবে। কলিকালে মানুষ স্নান না করে ভোজন করবে। কলিকালে স্ত্রীলোকরা নিতান্তই লোভী হবে, বহু ভোজনশীল হবে। স্ত্রীরা দুহাতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে অনায়াসে পতি আজ্ঞা অবহেলা করবে। নিজের দেহ পোষণে ব্যস্ত থাকবে, নিরন্তন কঠোর ও মিথ্যা বাক্য বলবে। আচারহীন ব্রাহ্মণপুত্ররা ব্রহ্মচারীর বেশ ধারন বেদ অধ্যয়ন করবে। গৃহস্থরা হোমাদি করবেন না এবং উচিত দানসমূহও প্রদান করবেন না। মানুষ অশাস্ত্রীয় তপস্যা করবে। কলিকালে ৮ থেকে ১০বছরের বালকেরা সহবাসে ৫ থেকে ৭বছর বয়সের বালিকারা সন্তান প্রসব করবে। মানুষের বুদ্ধি অতি অল্প ,তাঁদের ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তি অতিশয় কুৎসিত, তাদের অন্তকরণ অতিশয় অপবিত্র হবে। আর অল্প কালেই বিনাশ লাভ করবে। যখন পাষন্ড লোকের প্রভাব অত্যন্ত বাড়বে, তখন সমাজের ভালো লোক কোন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকবে না। সজ্জনের হানি লক্ষিত হবে। অল্প বৃষ্টি হবে, কলিকালে ফসল কম হবে। মানুষ শ্বশুরের অনুগত হয়ে, কার মাতা কার পিতা এরকম কথা বলবে। সুন্দরী স্ত্রী যার তার সাথে বন্ধুত্ব হবে, নিজ ভাইয়ের সাথে শত্রুভাব পোষন করবে। চৈতন্য মহাপ্রভুর মতে হরিনাম সংকীর্তনই হবে কলিযুগের একমাত্র ধর্ম। ভাগবতে বলা আছে ছলনা মিথ্যা আলস্য নিদ্রা হিংসা দুঃখ শোক ভয় দীনতা প্রভৃতি হবে এযুগের বৈশিষ্ট্য। মনু সংহিতায় বলা হয়েছে যে সত্যযুগে তপস্যা, ত্রেতায়ুগে জ্ঞান, দ্বাপরয়ুগে যজ্ঞ এবং কলিতে দানই প্রধান হয়।
কলিযুগের অবতার
বুদ্ধ অবতার আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতে জন্মগ্রহন করেন । কল্কি অবতার কলিযুগের শেষের দিকে আর্বিভাব ঘটবে ।শম্ভল গ্রামে (মোরাদাবাদ জেলায় ) সুমতি নামে ব্রাহ্মণ কন্যার গর্ভে , বিষ্ণুযশা নামে ব্রাহ্মণের বাড়িতে , কল্কি নামে ভগবান বিষ্ণুর দশম অবতারের আর্বিভাব ঘটবে । কল্কি হবে বিষ্ণুযশা-সুমতির চতুর্থ সন্তান । বিষ্ণুযশা-সুমতির প্রথম তিন সন্তানের নাম হবে যথাক্রমে কবি, প্রাজ্ঞ আর সুমন্তক ...........
খবর বিভাগঃ
কলি যুগ
0 মন্তব্য(গুলি):