বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই, ২০১৯

আমাদের ধর্মে বৈষ্ণব ও শৈব মতবিরোধঃ

আমাদের ধর্মে বৈষ্ণব ও শৈব মতবিরোধঃ
আমি যখনই সনাতন ধর্মের কোন পেইজে পোস্ট করি।শিব, বিষ্ণু তথা শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে অভিহিত করি, বৈষ্ণবরা বলেন শিবকে ভগবান বলা উচিত নয়, আর শৈবরা বলেন বিষ্ণুকে ভগবান বলা ঠিক নয়। এরকম মতবিরোধ ঠিক নয়, হিন্দুদের নিজেদের মধ্যেই যখন মত বিরোধ তখন অন্য ধর্মালম্বীরা তো ফায়দা লুটবে। কিন্তু বাস্তবে হিন্দুধর্ম একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী, ভগবান বিষ্ণু আর ভগবান শিব এক ও অদ্বিতীয়, একেশ্বরের বিভিন্ন রূপ মাত্র। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং শিবকে বলেছিলেন তোমাতে আর আমাতে যে বিভেদ করবে তার মত পাপী আর নেই।
আমি হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে বিস্তারিত আলোচনা করছি।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে সনাতন হিন্দুরা পঞ্চদেবতার উপসনা করেন। শিব, বিষ্ণু, কৃষ্ণ, আদিশক্তি, গণেশ । এর সাথে হিন্দুধর্মের চারটি শাখা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি।
শৈব, বৈষ্ণব(কৃষ্ণ সম্প্রদায় অন্তর্ভূক্ত), শাক্ত,গাণপত্য।এদের মধ্যে শৈব সবচেয়ে বেশি,কারণ পুরাণ মতে ভগবতী শক্তিদেবী দূর্গা আর দেবতা গণেশ ভগবান শিবের পরিবার। তাছাড়া ত্রিকালদর্শী প্রাচীন পৌরাণিক ঋষিদের ভবিষ্যবাণী অনুসারে, সংসারে সর্বাধিক ভক্ত ভোলেনাথ শিবের,শুধু মনুষ্য নয়, দেবতা, অসুর, ভূত, প্রেতাদি মহাদেব শিবের উপসনা করে। বৈষ্ণবধর্ম হিন্দুধর্মের একটি শাখাসম্প্রদায়, এই সম্প্রদায়ে ভগবান বিষ্ণু বা তাঁর অবতারগণ (মুখ্যত রাম ও কৃষ্ণ) আদি তথা সর্বোচ্চ ঈশ্বর রূপে পূজিত হন। বৈষ্ণব ধর্মমতের প্রধান তাত্ত্বিক ভিত্তি উপনিষদ, ভগবদ্গীতা, পদ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবত পুরাণ। বৈষ্ণবধর্মের বিষ্ণুকেন্দ্রিক সম্প্রদায়গুলি বিষ্ণু বা নারায়ণকে সর্বোচ্চ দেবতা মনে করে। আবার বল্লভ সম্প্রদায় বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মতো কৃষ্ণকেন্দ্রিক সম্প্রদায়গুলি কৃষ্ণকেই সর্বোচ্চ দেবতা তথা সকল অবতারের উৎস মনে করে।কিন্তু বিষ্ণু মতের অনুগামীরা(মধ্বা চার্য, রামানুজ) তা স্বীকার করেন না। বৈষ্ণবরা হিন্দু সমাজের অন্যতম বৃহৎ অংশদের সংখ্যাগরিষ্ঠের বাস ভারতে। পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও গুজরাটের মত পশ্চিম ভারতীয় রাজ্যগুলিতে এঁদের সংখ্যা অধিক। তবে সাম্প্রতিক কালে ধর্মসচেতনতা, স্বীকৃতি ও ধর্মপ্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বাইরেও বৈষ্ণবদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রসার সম্ভব হয়েছিল ১৯৬৬ সালে অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ প্রতিষ্ঠিত ইসকন আন্দোলনের ফলে।
বৈষ্ণবদের প্রধান প্রধান তীর্থগুলি হল:
বদরিনাথ, শ্রীরঙ্গম, বৃন্দাবন, মথুরা, অযোধ্যা, তিরুপতি,
পুরী, মায়াপুর ও দ্বারকা। শৈবধর্ম বা শৈবপন্থ হিন্দুধর্মের চারটি প্রধান সম্প্রদায়ের অন্যতম।এই ধর্মের অনুগামীদের "শৈব" নামে অভিহিত করা হয়। শৈবধর্মে ভগবান মহাদেব শিবকে সর্বোচ্চ দেবতা বলে মনে করা হয়, এই ধর্মের অনুগামীরা তাঁকেই স্রষ্টা, পালনকর্তা,
ধ্বংসকর্তা, সকল বস্তুর প্রকাশ বলে মনে করেন।শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ (রচনাকাল: খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ - ২০০ অব্দ)শৈব দর্শনের প্রাচীনতম গ্রন্থ। এই গ্রন্থেই প্রথম শৈব দর্শন সুসংহতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।শিব পুরাণ,লিঙ্গ পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, অগ্নি পুরাণ ও বায়ু পুরাণ হল শৈবদের প্রধান পুরাণ গ্রন্থ। এগুলি সবকটিই মহাপুরাণ শৈবদের প্রধান উপপুরাণগুলি হল সৌর পুরাণ, শিবপুরাণ, শিবধর্মোত্তর পুরাণ, শিব রহস্য পুরাণ, একাম্র পুরাণ, পরাশর পুরাণ, বশিষ্ঠলৈঙ্গ পুরাণ ও বিখ্যাদ পুরাণ। ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় শৈবধর্ম সুপ্রচলিত। ভারতে তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ , মধ্যপ্রদেশ,
মহারাষ্ট্র ,গুজরাট,ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড,কাশ্মীর,হিমাচল প্রদেশ, ওড়িশা ,কর্ণাটক, বারাণসী, উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি স্থানে এঁদের সংখ্যা অধিক। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়াতেও শৈবধর্মের প্রসার লক্ষিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক শিবমন্দির রয়েছে। এগুলির মধ্যে জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরগুলি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। সোমনাথ, মহাকালেশ্বর, মল্লিকার্জুন, ওঙ্কারেশ্বর, কেদারনাথ, কাশী বিশ্বনাথ, রামেশ্বরম, বৈদ্যনাথ, নাগেশ্বর, ত্র্যম্বকেশ্বর, ভীমাশঙ্কর,ঘৃষ্ণেশ্বর, ত্র্যম্বকেশ্বর, চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ, মহেশখালী আদিনাথ প্রভৃতি। প্রত্যেক সম্প্রদায়ই নিজ নিজ দেবতাকে সর্বোচ্চ দেবতা রূপে উপস্থাপিত করে। এইভাবে বিষ্ণুকেন্দ্রিক পৌরাণিক
সাহিত্যে বিষ্ণু শিবে "পরিণত হন"। বিষ্ণুপুরাণ (খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী) গ্রন্থের উপাখ্যান অনুসারে, বিষ্ণু জাগরিত হয়ে বিশ্ব সৃষ্টির জন্য ব্রহ্মা এবং তা ধ্বংসের জন্য শিবে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। ভাগবত পুরাণ অনুসারে, শিব বিষ্ণুরই একটি রূপমাত্র। অন্যদিকে শিবকেন্দ্রিক পৌরাণিক সাহিত্যে দেখা যায়, শিব একাই এবং স্বাধীনভাবেই বিশ্ব সৃষ্টি, রক্ষা ও ধ্বংস করছেন।শিবলিঙ্গের উৎপত্তি সংক্রান্ত একটি কাহিনী শিব পুরাণে আছে, জ্যোতির্লিঙ্গরূপী শিবের দেহ থেকেই বিষ্ণু ও বিষ্ণুর নাভি পদ্ম থেকে ব্রহ্মার উৎপত্তি হয়েছিল । শৈব শতরুদ্রীয়স্তোত্রে শিবকে "বিষ্ণুরূপী"-ও বলা হয়েছে।অথর্ববেদ সংহিতা গ্রন্থে, শিব শব্দের অর্থ মঙ্গলময় এবং লিঙ্গ শব্দের অর্থ প্রতীক; এই কারণে শিবলিঙ্গ শব্দটির অর্থ সর্বমঙ্গলময় বিশ্ববিধাতার প্রতীক। শিব শব্দের অপর একটি অর্থ হল যাঁর মধ্যে প্রলয়ের পর বিশ্ব
নিদ্রিত থাকে। ভাগবত অনুসারে শ্রীকৃষ্ণের ভক্তদের মধ্যে সেরা ভক্ত হচ্ছে শিব, শিবকে শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব ও বলা হয়। তিনি কৈলাসে বসে সর্বদা রাম নাম স্মরণ করেন,আবার শিব পুরাণ মতে, ভগবান বিষ্ণু পরম শৈব, বাল্মিকি রামায়নে রামচন্দ্র ভগবান শিবের পূজা করেছিলেন, যা রামেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ নামে ভারত মহাসাগর তীরে অবস্থিত। অতএব, এটা নিশ্চিত যে ভগবান বিষ্ণুর উপাস্য ভগবান শিব, আবার ভগবান
শিবের আরাধ্য ভগবান বিষ্ণু।শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং শিবকে বলেছিলেন যে, তোমাতে আর আমাতে বিভেদ করবে তার মত পাপী আর নেই।ঈশ্বর হরিহর হলেন বিষ্ণু (হরি) ও শিব (হর)-এর সম্মিলিত রূপ। এই রূপ হরিরুদ্র নামেও পরিচিত। মহাভারতে এই রূপের উল্লেখ রয়েছে।
"হর হর মহাদেব,হরে কৃষ্ণ,ওঁ বিষ্ণু,ওঁ নম
ভগবতে বাসুদেবায় নম,ওঁ নম শিবায়।"

অতএব আসুন, সকলে এই প্রার্থনা করি—
যথা শিবময়ো বিষ্ণুবেরং বিষ্ণুময়ঃ শিবঃ ৷
যথান্তরং ন পশ্যামি তথা মে স্বস্তিরাযুষি ৷৷
অর্থাৎ—‘বিষ্ণু যে প্রকার শিবময়, শিবও সে প্রকার বিষ্ণুময় ৷ আমার জীবন এমন মঙ্গলময় হোক যেন ইঁহাদের মধ্যে পার্থক্য না দেখি ৷’ (স্কন্দোপনিষৎ)

শেয়ার করুন

0 মন্তব্য(গুলি):